মেঘালয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক অপরূপ রাজ্য, যা তার অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং লাগাতার বর্ষণের জন্য বিখ্যাত। নয় শীত নয় গ্রীষ্ম, সব সময় যেখানে বর্ষণ হয়, সেই স্মৃতির পাতায় জমা অনেক কথা। দু বছর আগে সেখানে ভ্রমণ করে যে অভিজ্ঞতা হল, তা সত্যিই অসাধারণ ছিল। আগের পর্বে আমরা মেঘালয় ভ্রমন- এ যেন মেঘ পিয়নের মেঘালয় এ ঢাকা থেকে তামাবিল বর্ডারে এসেছি । এবার ডাউকি হয়ে শিলং।
অবিরাম বর্ষণের মধ্যে যাত্রা
সিলেট থেকে সকালে ট্রেন থেকে নেমে নাস্তা করে এখানকার বর্ষণ দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ছাড়ার কোন নামগন্ধ নেই। কখনও জোরে, কখনও আস্তে, অবিরাম ঝরে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় মেঘালয় ভ্রমণ করতে বের হওয়া সত্যিই দুঃসাহসিক। আবহাওয়ার পাতা খুলে দেখেছি, সব সময় বৃষ্টির ছবিই চোখে পড়েছে। কিন্তু এই বৃষ্টি দেখার জন্যই মেঘালয় ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভ্রমণ রুট
ঢাকা-সিলেট-টামাবিল বর্ডার-ডাউকি-শিলং
ইমিগ্রেশন অফিসের অভিজ্ঞতা
বেশ পানি জমেছে রাস্তায়। পিঠে ব্যাগ আর মাথার ছাতা সামলে আধভেজা অবস্থায় ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছালাম। ইমিগ্রেশন অফিসার আন্তরিকভাবে বললেন, আমি ভাল সময়ে এসেছি। এখন মেঘালয় ভারী সুন্দর। প্রসেসিং ও কাস্টমস কার্যাদি শেষ করে যখন সীমান্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছিলাম, তখন আবার মুষলধারে বর্ষণ শুরু হল। আগের মত মাথায় ছাতা ধরে হাঁটু পানি পার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করলাম। এটি জীবনের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
ডাউকি ইমিগ্রেশন অফিস ও ডাউকি বাজার
সীমান্ত পার হয়ে দেখি ডাউকি ইমিগ্রেশন অফিস অনেকটা পুরনো ইটের কুঁড়েঘরের মত, বেশ পুরোনো। পুরোনো হলেও একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে। কোন রকমে অফিসে ঢুকে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে করতে বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি কমে গিয়েছে। আমরা বাইরে বের হলাম। ডাউকি বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম চারদিকে অনেক গাছপালা, বৃষ্টির কারণে সতেজতা বেড়ে গিয়েছে। ডাউকি বর্ডার থেকে ডাউকি বাজার যাবার রাস্তাটাও বেশ সুন্দর।
শিলং যাওয়ার প্রস্তুতি
ডাউকি বাজারে পৌঁছানোর পর, ঘড়িতে তখন দুপুর বারটা। সেখান থেকে শেয়ার গাড়ি এবং ট্যাক্সি ভাড়া করে শিলং যাওয়া যায়। আশে পাশে তাকালে মাচাং এর মত বাড়ি সুন্দর এক কথায়। এরই মধ্যে দুপুর হয়ে গেল। আমরা সেই সকালে সিলেটে নাস্তা সেরে এসেছি। এরপর মোটা মুটি তিন চার ঘন্টার ভ্রমণ, তাই আমরা হাল্কা কিছু নাস্তা করে নিলাম। ডাউকি বাজারে খাবারের মান খুব ভাল না হলেও, কোন রকম উদরপূর্তি করে টাকা এক্সচেঞ্জ করে রুপি করে নিলাম।
ট্যাক্সি ভাড়া করা
মুল বিপত্তি ঘটল ট্যাক্সি ভাড়া করতে গিয়ে। এখানে বলতে গেলে ট্যাক্সি চালকদের একটি ইউনিটি আছে, কেউ খুব দামাদামি করতে পারেনা। যদি এক চালকের সাথে বনিবনা না হয়, তাহলে অন্য চালকরাও ডাবল ভাড়া চাইবে। তাই মোটামুটি একটা ভাড়া ঠিক করে যেতে হল। অবশেষে ১৬০০ রুপিতে একটি ট্যাক্সি পেলাম, যা সাইটসিং সহ শিলং পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
ডাউকি ব্রিজ ও পথের দৃশ্য
ট্যাক্সি যাত্রার শুরুতেই ডাউকি ব্রিজের দৃশ্য পেলাম। প্রবল বর্ষণে নদীতে এখন ভরা পানি। এখনকার পানি ঘোলা লাল মাটির পানির মত লাগছিল। ড্রাইভার বলছিলেন, শীতে পানি অনেক পরিষ্কার থাকে। মূলত বাংলাদেশের জাফলং থেকে এই সেতুটি অনেক সুন্দর দেখা যায়। তবে ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা নিষেধ। গাড়িতে যতে যেতে মেঘালয় ভ্রমণ কালে মেঘালয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
মেঘালয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি
মেঘালয়, যা “মেঘের বাসস্থান” নামে পরিচিত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি রাজ্য। এটি খাসি, গারো এবং জয়ন্তিয়া পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। মেঘালয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতিতে মিশে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পুরাকালের কাহিনী।
ইতিহাস
মেঘালয়ের ইতিহাস প্রাচীন এবং রহস্যময়। প্রাকৃত ইতিহাসে খাসি, গারো এবং জয়ন্তিয়া উপজাতিদের বসবাস ছিল এখানে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের পূর্বেই এই অঞ্চল গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মেঘালয় আগে আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালে এটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
- খাসি ও জয়ন্তিয়া জনজাতি:
- খাসি এবং জয়ন্তিয়া উপজাতিরা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুসারী। নারীরাই সমাজের প্রধান এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার।
- এই অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজ, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি চর্চা করে আসছে।
- গারো জনজাতি:
- গারো উপজাতিরাও মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসী। নারীরাই প্রধান এবং সমাজের নেতৃত্ব দেয়।
- গারো পাহাড়ে তাদের বসবাস এবং কৃষিকাজ তাদের প্রধান জীবিকা।
সংস্কৃতি
মেঘালয়ের সংস্কৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ। এখানকার মানুষের জীবনধারা, উৎসব, খাদ্যাভ্যাস এবং পোশাক সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট।
- উৎসব:
- নংক্রেম নৃত্য: খাসি উপজাতিদের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসব। এটি ফসল কাটার মৌসুমে উদযাপিত হয়।
- বেহ দিনখলম: জয়ন্তিয়া উপজাতিদের অন্যতম প্রধান উৎসব। এটি রোগবালাই থেকে মুক্তির জন্য উদযাপিত হয়।
- ওয়াংগালা: গারো উপজাতির প্রধান উৎসব। এটি নববর্ষ উপলক্ষে উদযাপিত হয়।
- নৃত্য ও সংগীত:
- খাসি, গারো এবং জয়ন্তিয়া উপজাতিরা বিভিন্ন নৃত্য ও সংগীতের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রকাশ করে। নংক্রেম, শাদ সুক মাইনসিয়েম, লাহো এবং ওয়াংগালা নৃত্য অন্যতম।
- হস্তশিল্প:
- মেঘালয়ের হস্তশিল্পে বাঁশ এবং বেতের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিখ্যাত। ঝুড়ি, টুপি, এবং মাদুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
- খাদ্যাভ্যাস:
- মেঘালয়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। এখানকার মানুষ ভাত, মাছ, মাংস এবং সবজির বিভিন্ন পদ খেতে পছন্দ করে।
- খাসি উপজাতির খাবারগুলির মধ্যে জাদো (মাংস এবং ভাত), তুংরিমবাই (মাংসের থালা), এবং নাকাম বিখ্যাত।
- গারো উপজাতির খাবারের মধ্যে পিকল্ড বাঁশের কঞ্চি, পাকা মাংস এবং মাছের বিভিন্ন পদ বিখ্যাত।
সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু ভ্রমণ নয়, এটি একটি শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা যা আপনাকে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ভুবনে নিয়ে যাবে।
রাস্তার অভিজ্ঞতা
এখানকার রাস্তা বেশ সুন্দর, খুব বেশি পেঁচানো না এবং প্রসস্ত। এগোতে এগোতে আশেপাশে সব খাসি সম্প্রদায়ের বসবাস দেখতে পেলাম। চলতে চলতে মেঘালয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি একটু জানার সুযোগও হল।
ভিউপয়েন্টে ভ্রমণ
ডাউকি থেকে শিলং এর রাস্তার অপরূপ দৃশ্য যে কারো মন কাড়তে বাধ্য। আমরা যাবার সময় বেশ কিছু ভিউ পয়েন্ট পেয়েছি যেগুলো ভীষণ সুন্দর। গাড়ী ক্ষণে ক্ষণেই মেঘের ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছিল। মেঘ এসে ঘিরে রাখে আবার ছেড়ে দেয়। পথের পাশে বৃষ্টিস্নাত ঘাস দমকা বাতাসে উড়ছে। গাড়ীর কাচ নামিয়ে মুখ আর হাত বের করে দিতেই যেন মেঘ বৃষ্টির অপার্থিব ছোয়া অনুভব করলাম। এপাশ ওপাশ সারা রাস্তায় যেন ভিউ পয়েন্ট। এরই মধ্যে আমরা সানসেট ভিউপয়েন্টে পৌঁছলাম, যার নাম Mawjngih Lapynshongdor View Point। সেখানে একটা কফি শপে গিয়ে থামল গাড়ি। আমরা ফার্স্ট ক্লাস একটা কফি খেয়ে নিলাম। সানসেট ভিউ পয়েন্ট এ কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমরা শিলংয়ের দিকে রওনা দিলাম। পথে আমরা আরো কিছু ভিউ পয়েন্ট পেয়েছি।
শিলং পৌছানো
এরই মধ্যে বিকেল নাগাদ আমরা শিলং পৌছালাম। পুলিশ বাজারে নেমে সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের দুরত্বে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেল ভাড়া ছিল ২০০০ রুপি। এরই মধ্যে ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীরের একটু রেস্ট দেওয়ার জন্য ।এখানে পুলিশ বাজারের আশে পাশেই অনেক হোটেল। এরই মধ্য আমি বেরিয়ে পরলাম কারন আগামিকালের জন্য টুরিস্ট বাস এর সিট এর বরাদ্দ করতে হবে। শিলং চেরাপুঞ্জি রুটের জন্য ৬০০ রুপিতে টিকেট কেটে নিলাম।পরদিইন সকাল ১১ টা থেকে যাত্রা শুরু। টিকেট কেটে চিন্তা করলাম আশেপাশে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমায় একজন পরামর্শ দিল রেপিডো ডাউনলোড করতে ।এরপর নিজের খেয়ালে শিলং সেন্টার থেকে বেলফন্ট ট্রেনিং সেন্টার এ। এখানে বাইকে ঘুরে অন্যরকম লাগছিল এত সুন্দর আবহাওয়া এত শান্ত পরিবেশ তখন ই মনে হয়েছে এবারের মেঘালয় ভ্রমন এর প্লান বেস্ট ছিল।
উপসংহার
ডাউকি থেকে শিলং পুরো রাস্তার সৌন্দর্য যেন যে কাউকে বুদ করে ফেলার মত, মেঘালয় ভ্রমণ সত্যিই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আরো অনেক জায়গা ঘুরবার আছে, আজকের পর্বে এটুকু। যদি আপনি প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কাটাতে চান, মেঘালয় ভ্রমন আপনার জন্য উপযুক্ত গন্তব্য। অবিরাম বর্ষণের মাঝে মেঘালয়ের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির ছোঁয়া যেমন আপনার মনকে শান্তি দেবে তেমনি আপনাকে এক অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশায় বুদ করে রাখবে। পরের পর্বে থাকছে “পাকদন্ডির শৈল শিলং”।